ভালো ব্যাংকের শেয়ার যাচাইয়ের উপায়

485

আমরা সবাই জানি যে গত এক বছরের কিছু বেশী সময় ধরে দেশের শেয়ার বাজার আপট্রেন্ডে রয়েছে। ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখে ডিএসইএক্স ইন্ডেক্স বা সূচক যেখানে ছিল ৩৬০৪ পয়েন্ট তা মোটামুটি দেড় বছরের মাথায় এসে বিগত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে দাঁড়িয়েছে ৭৩২৯ পয়েন্টে, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশী। সেটা নিশ্চয়ই ভাল খবর যে তালিকাভূক্ত অধিকাংশ কোম্পানী শেয়ারের দাম বাড়ছে ও ডিএসই’তে প্রতিদিনের গড় লেনদেন হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে। তবে লক্ষ্য করার মত বিষয় যে সাধারনভাবে সূচক বৃদ্ধি সত্বেও সব সেক্টর বা কোম্পানীর শেয়ারের দাম কিন্ত একইভাবে বাড়ছে না। আবার বাজার যে গতিতে বেড়ে চলেছে এবং বিশেষতঃ অনেক দূর্বল জাংক শেয়ারের দাম যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তার প্রভাব ভবিষ্যতে বিরুপ হওয়ার বিষয়ে অনেকই ক্রমশঃ আশংকিত হতে শুরু করেছেন।

দেশের শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর বা খাত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। আধুনিক যুগে যে কোন অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে সেদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি যত শক্ত হয় অর্থনীতিও তার সাথে তাল মিলে এগোতে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ব্যাংকেরও সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। সরকারী ও বেসরকারী খাতে অর্ধশতাধিক সিডিউলড ব্যাংক রয়েছে। তন্মধ্যে মোট ৩২টি ব্যাংক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত। ডিএসই’তে তালিকাভূক্ত মোট কোম্পানীর শতকরা ৮ ভাগের মত ব্যাংক খাতের হলেও প্রতিটি ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল অন্য খাতের কোম্পানীর তুলনায় অনেক বেশী হওয়ার কারণে বাজার মূলধনের বড় অংশই ব্যাংক খাতের সাথে সম্পৃক্ত। তাইতো প্রতিদিনের বাজারচিত্রে দেখা যায় যে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের সামান্য মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসেই ডিএসইএক্স সূচক উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে বা কমে।

করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পরপরই বিগত ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখে দেশে সর্বনিম্ন সূচকের পর অদ্যাবধি ওভারল মার্কেট সূচক ৭৩০০ এর উপরে উঠেছে। এরুপ বৃদ্ধির সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ারের দামও বেড়েছে। তবে অন্য অনেক সেক্টরে প্রাইস যেরুপ বেড়েছে এ সেক্টরে সে হারে বাড়েনি। ১৮ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত যেখানে ওভারঅল সূচক ১০৩.৩৫% বেড়েছে সেখানে ব্যাংক সেক্টরে প্রাইস বেড়েছে মাত্র ৬৭.৩২%। আর আমরা যদি ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ঠিক ২ বছরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করি তবে ওভারঅল সূচক প্রবৃদ্ধি ৪৮.১৫% এর বিপরীতে ব্যাংক শেয়ারের দাম বেড়েছে মাত্র ২৩.০৭% অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক। আরো লক্ষ্যনীয় যে ব্যাংকগুলোর দাম বৃদ্ধিতেও রয়েছে বেশ পার্থক্য। বর্তমানে প্রতিদিনের বাজার সূচক বেড়ে চললেও ব্যাংকিং সেক্টরের দামে কিছুটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। সেটার পিছনে প্রধানতঃ ৩টি কারণ – (১) ব্যাংকগুলোর হিসাব বছর ৩১ ডিসেম্বর যা বেশ কিছুটা দূরে বিধায় বর্তমানে জুন ক্লোজিং শেয়ারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশী, (২) ব্যাংকিং সেক্টরের প্রায় সব ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল অনেক বেশী থাকার ফলে মার্কেট ম্যানিপুলেটরদের পক্ষে কৃত্রিমভাবে ব্যাংকের শেয়ার প্রাইসকে ইনফ্লয়েন্স করা খুবই কঠিন, এবং (৩) এ সেক্টরে নানা অনিয়ম এবং বিভিন্ন ব্যাংকের বিরাট অংকের খেলাপী ঋণের তথ্য প্রতিনিয়ত মিডিয়ায় আসার ফলে ব্যাংকগুলোর ভাবমূর্তি সংকট তৈরী হয়েছে।

ডিএসইএক্স ইন্ডেক্স বর্তমানে এমন এক অবস্থানে পৌছে গেছে যা অনেক সেক্টর বা কোম্পানীর জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। কারণ তাদের প্রাইস-আর্ণিংস (পি-ই) রেশিও অনেক বেড়ে গেছে। বেশ কিছু কোম্পানীর পি-ই রেশিও ২০০ এর উপরে চলে গেছে। তার মানে হলো যে সেসব কোম্পানীর বর্তমান আয় যদি ভবিষ্যতে একই রকম বজায় থাকে এবং আয়ের পুরোটাই ডিভিডেন্ড আকারে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করা হয় তবে বর্তমানের কেনা দাম ফেরত পেতে সময় লাগবে ২০০ বছরের বেশী। সে অবস্থা কোনক্রমেই টেকসই হতে পারে না এবং ভবিষ্যতে কোন না কোন সময় তাদের দামের পতন অনিবার্য। তাই মার্কেটের বর্তমান ট্রেন্ড কোন কারণে বিপরীত্মূখী টার্ণ নিলে বা বড় ধরণের কারেকশন হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সেসব বিনিয়োগকারী যারা অত্যন্ত উচ্চ মূল্যে সেসব কোম্পানীর শেয়ার এখন ক্রয় করছেন। কিন্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য এখনো যথেষ্ট নিরাপদ শেয়ার হচ্ছে ব্যাংক সেক্টর যার পি-ই রেশিও মাত্র ১০.২। আবার যেসব ব্যাংকের আয়ের অবস্থা ভাল তাদের পি-ই রেশিও ৫ -৬ এর মধ্যে অবস্থান করছে। বিগত বছরগুলোতে ব্যাংকগুলো বিশেষত লাভজনক
ব্যাংকগুলো খুবই আকর্ষণীয় হারে ডিভিডেন্ড দিয়েছে। তাই সামনে ইয়ার এন্ড এর কাছাকাছি সময় ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সংগত কারণেই যেসব বিনিয়োগকারী বেশী ঝুঁকি নিতে রাজী নহেন তাঁরা নিরাপদ বিনিয়োগের লক্ষ্যে ভাল ব্যাংকের শেয়ার কিনতে পারেন। ব্যাংক ভাল হলে তার শেয়ার কিনে সংগতভাবেই তুলনামূলক দূর্বল ব্যাংকের চেয়ে রিটার্ন বেশী পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো ভাল ব্যাংকের শেয়ার কিভাবে চেনা যাবে?

ভাল ব্যাংক বলতে সেসব ব্যাংক বুঝায় যাদের ব্যবসা সন্তোষজনক, রিজার্ভ বেশী, রিটার্ন অন এসেট, রিটার্ন অন ইক্যুইটি এবং ক্যাশ ফ্লো আকর্ষণীয়। তাছাড়া, ব্যাংকের স্পন্সর বা ডিরেক্টরগণ ম্যানেজমেন্টের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে না বা দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঋণ বিতরণ করা হয় না। এসবের বাইরে তিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর হচ্ছে ব্যাংকের খেলাপী ঋণের হার, ব্যবসা তথা ইপিএস এর প্রবৃদ্ধি এবং বিগত বছরগুলোতে মোট লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড প্রদানের রেকর্ড। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অনাদায়ী তথা খেলাপী ঋণের অস্বাভাবিক হার। বিগত ৩০ জুন ২০২১ তারিখের হিসাব মোতাবেক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রদত্ত ঋণের প্রায় ৮.০৫% বর্তমানে খেলাপী ঋণ বা Non Performing Loan (NPL), যা বিগত ২০২০ সনের ৩০ জুন ছিল ৯.৩২%। এর মধ্যে সরকারী ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ গড়ে ২১.০৩% এবং বেসরকারী ব্যাংকগুলোর গড়ে ৪.৮২%। করোনার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ প্রভিশনিংয়ে বিশেষ ছাড় না দিলে এরুপ অবস্থা এতদিনে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতো বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের অনুমান। তবে বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপী বা অনাদায়ী ঋণ পরিস্থিতি ব্যাংকভেদে ভিন্ন ভিন্ন। অনেক ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের অনাদায়ী বা খেলাপী ঋণের হার অনেকাংশে কমাতে সক্ষম হয়েছে। তাই কোন ব্যাংকের শেয়ার কেনার পূর্বে তার ঋণের NPL অবস্থা দেখা উচিত। এটাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকটির ইপিএস এর প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না কমছে এবং বাড়লে তা কি হারে বাড়ছে তা দেখা। বিগত সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কি হারে ক্যাশ কিংবা স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল সেটাও বিবেচনা করতে হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত ব্যাংক খাতে্র ৩২টি কোম্পানীর মধ্যে ভাল ব্যাংক চিহ্নিতকরণ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে নীচে মোট ১১টি ব্যাংকের সর্বশেষ নিরীক্ষিত হিসাবের ভিত্তিতে খেলাপী ঋণের হার, ক্যাশ এবং স্টক বা বোনাস মিলিয়ে গত ২ বছরে মোট ডিভিডেন্ড প্রদানের অবস্থা এবং ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ঠিক ২ বছরে ইপিএস প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হলো। উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলোর ইয়ার এন্ড ৩১ ডিসেম্বর হওয়ার ফলে সেকেন্ড কোয়ার্টার অর্থাৎ ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত ইপিএস’কে এ্যানুয়ালাইজড করে বার্ষিক ইপিএস বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

খেলাপী ঋণের হার, অতীতে প্রদত্ত ডিভিডেন্ড হার এবং ইপিএস প্রবৃদ্ধির সাথে শেয়ার প্রাইস বৃদ্ধি বা প্রাপ্ত রিটার্নের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বুঝার জন্য নীচের টেবিলে বিগত ২ বছরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ক্যাপিটাল গেইন বা রিটার্নের হারও উল্লেখ করা হয়েছে।

উপরের টেবিল থেকে দেখা যাচ্ছে যে ইপিএস প্রবৃদ্ধির হারের সাথে ব্যাংকের প্রাইস প্রবৃদ্ধির পজিটিভ এবং খেলাপী ঋণের সাথে প্রাইস প্রবৃদ্ধির নেগেটিভ সম্পর্ক বিদ্যমান।

যেসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ভাল, সুশাসন রয়েছে এবং তার ফলে তারা NPLপরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে উত্তরোত্তর আয়ের প্রবৃদ্ধি আনয়নে সক্ষম হয়েছে বা হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যারা ভাল ডিভিডেন্ড প্রদান করেছে সেসব ব্যাংকের শেয়ার থেকে খুবই আকর্ষণীয় রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। সেসব ভাল ব্যাংকের শেয়ার কিনে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তাই বলা যায় যে আর্থিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানের সাথে ব্যাংকের শেয়ার প্রাইস প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তবে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে উপরের টেবিলে প্রদর্শিত যেসব ব্যাংকের উচ্চ NPL এবং নেগেটিভ ইপিএস প্রবৃদ্ধি হয়েছে তাদের শেয়ারের দামও তো বেড়েছে। সেটা হয়তো হয়েছে। তবে তাদের দাম বেড়েছে ওভারঅল মার্কেট আপট্রেন্ডের ফলে। অধিকন্ত ভাল ব্যাংকের শেয়ার দাম তুলনামূলকভাবে বেশী বেড়েছে।

সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা খেয়াল না রাখলেও অভিজ্ঞ ও প্রাতিষ্টানিক বিনিয়োগকারীগণ ঠিকই কিন্ত প্রতিটি ব্যাংকের এবং তাদের টার্গেটকৃত কোম্পানীর অতীত ডিভিডেন্ড রেকর্ড, কোয়ার্টারলি ইপিএস ট্রেন্ড এবং খেলাপী ঋণের হাল-হকিকতের খবর রাখেন। ফলে দেখা যায় যে বাজারে বড় পুঁজির অভিজ্ঞ ও প্রাতিষ্টানিক বিনিয়োগকারীগণ যে হারে লাভবান হন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগণ সেভাবে লাভবান হন না। আবার মার্কেট পতনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হন স্বল্প পুঁজির ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগণ। সেজন্যই প্রয়োজন সাধারন বিনিয়োগকারীদের ফিনান্সিয়াল লিটারেসী অর্জন যার মাধ্যমে তাঁরা আপেলকে আপেলের সাথেই তুলনা করতে শিখবেন- ট্মেটোর সাথে নয়। সেটি বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটকে স্থিতিশীল করার স্বার্থেই প্রয়োজন।

সতর্কতাঃ বর্ণিত কোম্পানীগুলোর পারস্পরিক তুলনায় পাবলিক ড্যাটা ব্যবহার করা হয়েছে। আর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে তা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত যার সাথে বাস্তবের মিল নাও থাকতে পারে। তাই এ প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোন কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয় না করার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় কারো ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষতির জন্য কোনক্রমেই লেখক দায়ী থাকবে না।

লেখক:

শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব (অবঃ)
Email- msislam201386@gmail.com